বাংলাদেশ এখন একটি নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের দোরগোড়ায়। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সমগ্র দেশ রাজনীতি, নেতৃত্ব এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে ব্যস্ত আলোচনায় নিমগ্ন। কিন্তু নির্বাচনোত্তর সময়ে, একটি নির্বাচিত সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হবে — দেশের ডিজিটাল উন্নয়নকে পুনর্নবীকৃত অগ্রাধিকার হিসেবে গ্রহণ করা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য একটি সুসংগঠিত জাতীয় রূপরেখা প্রণয়ন করা।
ডিজিটাল উন্নয়ন: নাগরিক প্রত্যাশা ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা
বাংলাদেশে ডিজিটাল রূপান্তর আর কেবল প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নয়, এটি এখন সামাজিক পরিবর্তনের এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রশাসন, শিল্প, এমনকি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তি সাধারণ নাগরিকের জীবনধারায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।
এ প্রেক্ষিতে, ডিজিটাল উন্নয়ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং মানবিক সক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তাই নাগরিকদের প্রত্যাশা হলো—নতুন সরকার ডিজিটাল উন্নয়নকে জাতীয় পরিকল্পনা, নীতি ও বাজেট কাঠামোর কেন্দ্রীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করবে।
ডিজিটাল উন্নয়নের চারটি প্রধান স্তম্ভ
ডিজিটাল উন্নয়ন একক কোনো প্রকল্প নয়; বরং এটি একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া, যা চারটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে:
• ডিজিটাল রূপান্তর: অর্থনীতি, সমাজ ও সরকারি সেবায় তথ্যপ্রযুক্তি, ডেটা ও উদ্ভাবনের সংযোজনের মাধ্যমে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি।
• ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি: নারী, যুব, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সমান ডিজিটাল সুযোগ ও প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
• ডিজিটাল দায়িত্বশীলতা: সাইবার নিরাপত্তা, তথ্যের গোপনীয়তা, অনলাইন নৈতিকতা ও মানবাধিকারের সুরক্ষা।
• ডিজিটাল টেকসইতা: পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো, দীর্ঘমেয়াদি নীতি এবং জলবায়ু-বান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার।
এই চারটি স্তম্ভ কেবল প্রযুক্তিগত নির্দেশনা নয়—এগুলো বাংলাদেশের সামাজিক চুক্তির নতুন রূপ, যেখানে রাষ্ট্র, বাজার ও নাগরিক সমাজ একসঙ্গে কাজ করবে “ ডিজিটাল জাতি”-এর পরবর্তী অধ্যায় নির্মাণে।
নীতিগত প্রতিশ্রুতি ও কর্মপরিকল্পনা
একটি নতুন সরকারের প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত অগ্রাধিকার নির্ধারণের স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া। ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে ঘোষণা করতে হবে যে ডিজিটাল উন্নয়ন কেবল একটি খাত নয়, বরং এটি জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু।
দ্বিতীয়ত, সরকারের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই একটি মধ্যমেয়াদি ডিজিটাল উন্নয়ন রোডম্যাপ (Medium-Term Digital Development Roadmap) প্রণয়ন করতে হবে, যা জাতীয় পরিকল্পনা প্রক্রিয়া—বিশেষত “Perspective Plan” ও “Five-Year Plan”-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকবে।
এই রোডম্যাপের আওতায় ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন, ডেটা গভর্নেন্স, সাইবার নীতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ব্যবহার এবং ডিজিটাল অর্থনীতির সম্প্রসারণের জন্য স্পষ্ট সূচক ও দায়িত্ব নির্ধারণ করতে হবে।
বৈশ্বিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য
বাংলাদেশের ডিজিটাল উন্নয়ন পরিকল্পনাকে জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক নীতিনির্ভর কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা জরুরি। কারণ, আজকের ডিজিটাল রূপান্তর স্থানীয় নীতি দিয়ে নয়—বৈশ্বিক সমন্বয় ও প্রযুক্তিগত ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।
১. The Pact for the Future (2024): ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মানবকেন্দ্রিক প্রযুক্তি ও টেকসই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করে।
২. WSIS+20 Review (World Summit on the Information Society): তথ্যসমাজ গঠনে ২০ বছরের অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন দিগন্ত নির্ধারণ করে।
৩. UN Global Digital Compact (GDC): একটি উন্মুক্ত, নিরাপদ ও ন্যায্য ডিজিটাল ভবিষ্যতের জন্য বৈশ্বিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে।
৪. Internet Governance Forum (IGF): বহুপক্ষীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে ইন্টারনেট নীতি, মানবাধিকার ও উন্নয়নকে সংযুক্ত করে।
৫. AI for Good Initiative: জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দায়িত্বশীল ও নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করে।
এই কাঠামোগুলো বাংলাদেশের জন্য শুধু নির্দেশনাই নয়—এগুলো আমাদের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ গঠনের আন্তর্জাতিক নীতিনির্ভর পরিমাপক।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৌশলগত প্রয়োজন
বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছে। এখন সময় এসেছে ডিজিটাল ২.০ যুগে প্রবেশের, যেখানে রূপান্তর হবে “অ্যাক্সেস” থেকে “ক্ষমতায়ন”-এর দিকে।
• স্থানীয় উদ্ভাবন ও যুব নেতৃত্ব: স্থানীয় পর্যায়ে উদ্ভাবন ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে জাতীয় পরিকল্পনায় সংযুক্ত করা।
• ডিজিটাল শিক্ষা ও দক্ষতা: স্কুল-কলেজ পর্যায়ে কোডিং, রোবোটিকস, AI ও ডেটা লিটারেসি অন্তর্ভুক্ত করা।
• ডিজিটাল সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার: অনলাইন সহিংসতা, তথ্যবিকৃতি ও গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে দৃঢ় আইনগত কাঠামো।
• ডিজিটাল অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান: ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল ব্যাংকিং ও ব্লকচেইনভিত্তিক সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
উপসংহার
ডিজিটাল উন্নয়ন এখন বাংলাদেশের জাতীয় অগ্রগতির অনিবার্য অংশ। এটি কেবল প্রযুক্তি নয়—এটি রাষ্ট্রীয় আধুনিকায়নের প্রতীক, জনগণের অংশগ্রহণের প্ল্যাটফর্ম, এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের মর্যাদা পুনর্নির্ধারণের হাতিয়ার।
একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, দায়িত্বশীল এবং টেকসই ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের মধ্য দিয়েই নতুন সরকার জাতিসংঘ ঘোষিত “Leaving No One Behind” নীতির প্রকৃত প্রতিফলন ঘটাতে পারবে।
এ এইচ এম. বজলুর রহমান, এমএসএস (সরকার ও রাজনীতি), এলএল.বি, ডিজিটাল গণতন্ত্র বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশের জন্য দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যাম্বাসেডর | ceo@bnnrc.net |








০ টি মন্তব্য