https://comcitybd.com/brand/Havit

প্রযুক্তি

ন্যানোপ্রযুক্তির অবাক জগৎ

ন্যানোপ্রযুক্তির অবাক জগৎ ন্যানোপ্রযুক্তির অবাক জগৎ
 

ন্যানোপ্রযুক্তির অবাক জগৎ


শিগগিরই মানুষ এমন বাড়ি তৈরি করবে, যার বাইরের দেয়ালের রং সোলার প্যানেল হিসেবে কাজ করবে। আর এসব বাড়িতে এমন ধরনের ইট ব্যবহার হবে, যার প্রতিটি ইট এক-একটি ব্যাটারি হিসেবে কাজ করবে। আর এটি প্রযুক্তিবিদেরা সম্ভব করে তুলছেন ন্যানোটেকনোলজিকে কাজে লাগিয়ে। এই ন্যানোটেকনোলজি অদূর ভবিষ্যতে আমাদের চারপাশের জগৎ ও এমনকি আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে অভাবনীয় মাত্রায় পাল্টে দিতে পারে।


ন্যানোটেকনোলজি আসলে কী?


এক সময় মনে হতো আমাদের পৃথিবীটা অনেক বড়। কিন্তু প্রযুক্তির সুবাদে পৃথিবীটা যেন ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। এই পৃথিবীতে আমরা অনেক কিছুই খালি চোখে দেখি। এর বাইরে এমন অনেক ক্ষুদ্র কিছু রয়েছে, যেগুলো আমরা খালি চোখে দেখতে পারি না। সেগুলো দেখতে আমাদের প্রয়োজন হয় মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্র। সেটা হচ্ছে মাইক্রোস্কোপিক বা আণুবীক্ষণিক জগৎ। কিন্তু এই মাইক্রোস্কোপিক জগতের বাইরে এর চেয়েও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিছু রয়েছে, যাকে বিজ্ঞানীরা বলছেন ন্যানোস্কোপিক জগৎ। আমরা যেসব সাধারণ বস্তু বা আণুবীক্ষণিক বস্তু নিয়ে কাজ করি ন্যানো জগতের বস্তু এর চেয়ে শত শত কোটি গুণ ছোট। আর ন্যানো জগতের এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু নিয়ে যে প্রযুক্তির মহাজগৎ গড়ে উঠেছে বা উঠছে, সেটাই হচ্ছে ন্যানোটেকনোলজি। এই প্রযুক্তি গড়ে তোলা হয়েছে ন্যানো স্কেলে তথা ন্যানো পরিমাপে। আর এসবের ব্যবহার আমরা বাস্তব জীবনেও করতে পারি। ন্যানোটেকনোলজির কাজ হচ্ছে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্ত্রকে জানা এবং এসব বস্তুর প্রাযুক্তিক ব্যবহার। 


এই ন্যানো স্কেল বা পরিমাপটি আসলে কতটা ছোট, তা আরো স্পষ্ট করে বোঝার জন্য কিছু উদাহরণ নেয়া যাক। কারণ, বাস্তব উদাহরণ ছাড়া তা বুঝা যাবে না। আমরা যে বলপেন দিয়ে লিখি তার নিব কয়েক শত কোটি ন্যানোমিটার। মানুষের চুল মোটামুটি ৫০ হাজার ন্যানোমিটার মোটা। একটি সাধারণ কাগজ প্রায় ৭৫ হাজার ন্যানোমিটার পুরো হয়। একটি ডিএনএ ১ ন্যানোমিটার। একটি প্রোটন ১০ ন্যানোমিটার। ন্যানোমিটার হচ্ছেÑ গজ, ফুট, মাইল, কিলোমিটার, মিটারের মতো দৈর্ঘ্যরে একটি একক। গণিত বিজ্ঞানের হিসাব মতে, ১ ন্যানোমিটার হচ্ছে ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগের সমান। সোজা কথায় ১ মিটার দীর্ঘ একটি লাঠিকে যদি সমান ১০০ কোটি ভাগ করি তবে এর ১ ভাগ যত দীর্ঘ হবে, সেটাই হচ্ছে ১ ন্যানোমিটার। ভাবুন তো, কত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই ন্যানোমিটার! 


এখন প্রশ্ন হচ্ছে ন্যানোপ্রযুক্তিতে যদি এতটা ক্ষুদ্র পর্যায়ে কাজ হয়, তবে এই প্রযুক্তিকে আমাদের জীবনে কী করে কাজে লাগানো যায়? আসলে আমাদের জানা-বোঝা দরকার, আমরা যে মহাবিশ্বে কাজ করি তা আসলে কী প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। তা জানা গেলে আমরা এসব ন্যানোবস্তুকে কাজে লাগিয়ে আমাদের জীবনের অনেক অবাক করা কাজ সারতে পারব। আমরা যখন ন্যানোস্কেলে প্রবেশ করি, তখন আমরা পদার্থবিজ্ঞানের এমন সব জায়গায় কাজ করি, যা সাধারণত করা সম্ভব হয় না। তবে এমনকি এটাও মনে করা হয়, ন্যানো সাইজ ও ন্যানোটেকনোলজি আমাদের আশপাশের পরিবেশকে পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে। 


আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছিÑ পৃথিবীর সবকিছুই অণু বা অ্যাটম দিয়ে  তৈরি। আমাদের প্রতিটি খাবার, পরার কাপড়, আমাদের বাড়িঘর, আসবাবপত্র ইত্যাদি যা কিছুই বলি, সবই অণু দিয়ে তৈরি। এমনকি আমাদের শরীরও অণু দিয়ে তৈরি। ভেবে দেখুন তো, একটি গাড়ির মধ্যে যা কিছু আছে তা এই একই অণু। এসব অণু দিয়ে তৈরি গাড়ির পার্টসগুলোকে আমাদের ইচ্ছেমতো গঠন করে সাজিয়ে স্থাপন করেছি বলেই গাড়িটি স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারছি। আমাদের চারপাশের জগতের অণুগুলো যেভাবে সাজানো আছে, সেভাবেই পরিবেশটি গড়ে উঠেছে। এখন আমরা চাইলে এগুলোতে নতুন করে সাজিয়ে নতুন এক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি। সেই সাথে আমাদের ইচ্ছেমতো সেসব জিনিসকে কাজে লাগাতে পারি। ঠিক যেভাবে একই ধরনের ইট ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের বাড়ি তৈরি করা যায়। আসলে কোনো বস্তুকে যদি ছোট করা হয়, তবে সে বস্তুর গুণাগুণও পরিবর্তন হয়ে যায়। একই বলা হয় কোয়ান্টাম ইফেক্ট। এই কোয়ান্টাম ইফেক্টই জানিয়ে দেয়, কোনো বস্তুকে ছোট করলে এর গুণাগুণ বা আচরণে কতটুকু বা কী ধরনের পরিবর্তন আসবে। আমরা বুঝতে পারি কোনো পদার্থ ন্যানোস্কেলে কতটুকু পরিবর্তিত হবে এবং কীভাবে কাজ করবে। বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম ইফেক্ট কাজে লাগিয়ে কোনো পদার্থের গুণাগুণ সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেন এবং আমাদের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারেন। বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই এই কাজটা করে আসছেন। এভাবেই সম্ভব হয় কোনো পদার্থের মেল্টিং পয়েন্টকেও পরিবর্তন করা। যেমন :  ফ্লোরেসেন্স। এমনকি ইলেকট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটিকেও পরিবর্তন করা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা যদি এসব কিছু নিয়ে কাজ করে থাকেন, তবে বাস্তব জীবনে এর উদাহরণ আমরা কেনো দেখতে পাই না। 


জানিয়ে রাখি, হয়তো জানেন না আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহারের অনেক বস্তুই বানানো সম্ভব হয়েছে ন্যানোপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে। যেমন : স্মার্টফোনের কাচের পর্দার ওপর আমরা এর সহজে ভেঙে যাওয়া ও বিরক্তকর দাগ ঠেকাতে স্বচ্ছ কাচের মতো যে একটি আবরণ জুড়ে দিই, সেটি কিন্তু তৈরি করা হয়েছে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার করেই। এর নাম ‘ক্লিয়ার ন্যানোস্কেল ফিল্ম’। দামি গাড়ি, উড়োজাহাজ ও অনেক মহাকাশযানকে যথাসম্ভব হালকা দ্রব্য দিয়ে তৈরি করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে ন্যানোপ্রযুক্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। আমাদের কমপিউটারের মেমরি চিপ ও প্রসেসর সময়ের সাথে ক্রমেই ছোট হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এগুলোর কাজের ক্ষমতা বা পারফরম্যান্স আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। এগুলো কাজও করছে আগের চেয়ে অনেক বেশি দ্রæত গতিতে। যতই দিন যাচ্ছে, আমরা আমাদের স্মার্টফোনকে আরো বেশি স্মার্ট করে তুলছি। এখন আমাদের হাঁটা থেকে যে এনার্জিটা তৈরি হবে, সেটাকে ন্যানোজেনারেটের সাহায্যে আমরা ফোন চার্জ করতে ব্যবহার করতে পারি। আমরা ন্যানোপ্রযুক্তির সাহায্যে ওষুধকে সেই যথাযথ স্থানটিতে প্রয়োগ করতে পারি, ঠিক যে জায়গাটুকুতে তা প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে আমরা ওষুধ প্রয়োগেেক আরো বেশি কার্যকর করে তুলতে পারছি। এর ফলে ওষুধও কম লাগে এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম হয়। এগুলো ন্যানোপ্রযুক্তি প্রয়োগের সামান্য কয়টি উদাহরণ মাত্র। 


বর্তমানে আমরা একটি কমপিউটারকে অর্থাৎ একটি ল্যাপটপকে আমাদের ব্যাগে করে যেখানে-সেখানে নিয়ে যেতে পারি। বিষয়টি আমাদের কাছে এখন আর অবাক করা কোনো ব্যাপার মনে হয় না। এখন এটি আমাদের কাছে একটি স্বাভাবিক ও সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু কয়েক দশক আগে মনে হতো এটি একটি অবাস্তব কাজ। তখন যে কমপিউটার ব্যবহার হতো, সেটি ছিল আজকের দিনের কমপিউটারের তুলনায় কয়েক লাখ গুণ ধীরগতির, কিন্তু এর আকার ছিল একটি ঘরের মতো। সেই সময়ের মানুষ ভাবেনি একটি কমপিউটারকে একটি ব্যাগে করে যেখানে-সেখানে নিয়ে যাওয়া কোনোদিন সম্ভব হবে। কিন্তু আজ তা বাস্তব। আর তা সম্ভব হয়েছে শুধু মাইক্রোপ্রসেসরকে আরো ছোট করে আনার ফলে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ট্র্যানজিস্টরের কথা বলতে পরি। এই ট্র্যানজিস্টর দিয়ে মাইক্রোপ্রসেসর তৈরি হয়। এই কয়েক বছরের মধ্যে মাইক্রোপ্রসেসরের আকার এতটা ছোট হয়ে গেছে যে, তা কল্পনাও করা যায় না। এই তো ২০০০ সালেও যেসব ট্র্যানজিস্টর ব্যবহার করা হতো, সেগুলোর সাইজ ছিল ২৫০ ন্যানোমিটার। ২০১৬ আসতে আসতে আমাদের ব্যবহারের ট্র্যানজিস্টরের সাইজ হয়ে যায় মাত্র ১ ন্যানোমিটার। 


ইন্টারনেটে আমরা দেখতে পাই মোবাইলের ফ্লেক্সিবল মোবাইল স্ক্রিন, যেটাকে পেইন্ট করা যায়, মোড়ানো যায়, ভাঁজ করা যায়। এগুলো কল্পবিজ্ঞানের কোনো বিষয় নয়। এগুলো এখন পুরোপুরি বাস্তব। এই স্ক্রিনগুলো তৈরি করতে ব্যবহার হয় সেমিকন্ডাক্টর ন্যানো মেইনফ্রেম। এগুলোর মনোক্রিস্টালাইজড স্ট্রাকচার মাত্র ১০০ ন্যানোমিটারের কাছাকাছি মোটা হয়। 


এসব উদাহরণ তো ছিল মাত্র ডিজিটাল ও মেডিক্যাল টেকনোলজির ব্যাপারে। কিন্তু এই ন্যানোটেকনোলজিকে ব্যবহার করে আমরা পৃথিবীতে ক্রমেই বাড়তে থাকা অনেক সমস্যার সমাধানও করতে পারি। 


ধারণা করা হয়, ন্যানোপ্রযুক্তি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সমাধান করতে পারবে পৃথিবীর পরিবেশ ও আবহাওয়া সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে। এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আমরা পৃথিবীর নানা ধরনের কাঁচামাল, পানি ও জ্বালানিকে বাঁচাতে পারব। এমনকি বায়ুমÐল থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাসকেও কমিয়ে আনা যেতে পারে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যদি কোনো পদার্থের স্ট্রেসকে বাড়াতে পারি, তবে এটি আরো বেশিদিন টিকবে। তা চলবে অনেক বেশিদিন। এর ফলে শিল্পকারখানায় কাঁচামাল ব্যবহার কম লাগবে। ৯৫ শতাংশ সিলিকন-বেইজড যেসব সোলার প্যানেল বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়, সেগুলোতে ন্যানোপ্রযুক্তির প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। আর এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এমন রং তৈরি করা যেতে পারে, যা একটি বাড়ির বাইরের দেয়ালে লাগালে সেটা সোলার প্যানেল হিসেবে কাজ করবে। আর এই সোলার প্যানেলই এ বাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছেন সোলার ক্রিস্টাল। এই ক্রিস্টাল কোনো তরলের মাঝে মিশিয়ে দিয়ে আকর্ষণীয় রং তৈরি করা যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো : তাহলে আমরা এই রং চাইলেই বাজারে কিনতে পাই না কেনো? কারণ, এই ন্যানোক্রিস্টাল তৈরির জন্য ক্যাডমিয়াম নামের একটি ধাতু ব্যবহার করা হয়। এটি খুবই বিষাক্ত ধাতু। তাই এই রং বাজারে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য কোনো দেশের সরকার অনুমতি দেয় না। তাই বিজ্ঞানীরা ক্যাডমিয়ামের বদলে নতুন কোনো পদার্থ খুঁজছেন, যার সাহায্যে এই রং তৈরি করা যেতে পারে, যাতে এই রং সাধারণ মানুষের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ হতে পারে। তখন এই রং ব্যবহার করে নিরাপদে আমাদের পুরো বাড়িটাই সৌর জ্বালানিতে ভরপুর করে দিতে পারব। কিন্তু এই সৌর জ্বালানি মজুদ করা হবে কোথায়? এর জন্য একটা বিশেষ ব্যবস্থা আছে। 


ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বাড়ির দেয়ালের জন্য এমন ইট তৈরি করা যেতে পারে, যে ইট কাজ করবে একটি ব্যাটারি হিসেবে। ঠিক ব্যাটারি নয়, বরং বলতে পারেন সুপার ক্যাপাসিটর। এই টেকনোলজিকে বলা হয় : Assisted Vapor Phase Polymerization। তবে এই প্রযুক্তি সম্পর্কে আমরা এখনো খুব বেশি জানি না। কারণ, এই প্রযুক্তিটির অবস্থান এখনো অনেকটা প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত যদি এই প্রযুক্তির সফল অগ্রগতি ঘটে, তবে আমরা হয়তো পেতে পারি অবাক করা নতুন আরো অনেক কিছুই। আজকের দিনে মানুষ অনেক দ্রæত গতিতে প্রযুক্তিতে অগ্রগতি অর্জন করছে। তবে মনে হয়, আমরা ভবিষ্যতের ন্যানোপ্রযুক্তির এই অবাক করা দুনিয়া থেকে খুব একটা দূরে নই।


ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগ


ন্যানোটেকনোলজি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সহযোগিতা করছে অনেক প্রযুক্তি ও শিল্পখাতের উন্নয়নে। এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনায়। এসব ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে : তথ্যপ্রযুক্তি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, চিকিৎসা, পরিবহন, জ্বালানি, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ বিজ্ঞানসহ অনেক ক্ষেত্রে।


প্রতিদিনের পণ্য প্রক্রিয়ায়


আসলে ন্যানোপ্রযুক্তির  মাধ্যমে একটি বস্তুকে ইচ্ছেমতো ছোট কাঠামো দেয়া যায়; কোনো সুনির্দিষ্ট গুণাবলি অর্জনের লক্ষ্যে। এই সত্যটির ওপর নির্ভর করে ন্যানোটেকনোলজির নানা উপকারিতা পাচ্ছি। এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে কোনো বস্তুকে কার্যকরভাবে আরো শক্ত, হালকা, অধিকতর টেকসই, ক্রিয়াশীল ও আরো উন্নত বিদ্যুৎ পরিবাহী করে তোলা যায়। বাজারের প্রতিদিনের নানা ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য এখন তৈরি হয় ন্যানোস্কেল বস্তু প্রক্রিয়াজাত করে। ক্লিয়ার ন্যানোস্কেল ফিল্ম আজ ব্যবহার হচ্ছে চশমার গøাসে, কমপিউটার ও ক্যামেরার পর্দায়, জানালায় ও এমনি আরো নানা ডিভাইসেÑ যাতে এগুলো পানিরোধী, প্রতিফলনরোধী, ক্ষুদ্র জীবাণুরোধী, কুয়াশারোধী ও দাগরোধী হয় এবং আপনা থেকেই এগুলোকে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ রাখে। সেই সাথে বস্তুর বিদ্যুৎ পরিবাহী ক্ষমতা বাড়ে। ন্যানোস্কেলের বস্তু দিয়ে তৈরি হতে শুরু করেছে ধুয়ার উপযোগী ও টেকসই ‘স্মার্ট ফেব্রিকস’। এসব স্মার্ট কাপড়ে থাকছে ন্যানোস্কেলের সেন্সর ও ইলেকট্রনিকস, যা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যাপার মনিটর করবে। এটি মজুদ করতে পারবে সৌর জ্বালানি ও হাঁটাচলা থেকে পাওয়া জ্বালানি। গাড়ি, ট্রাক, নৌকা, উড়োজাহাজের ওজন কমানো যাবে ন্যানোস্কেলের বস্তু দিয়ে এসব তৈরি করে। এতে সাশ্রয় হবে এসবের জ্বালানি। পলিমার কমপোজিট ম্যাটেরিয়ালের ব্যবহার হচ্ছে ন্যানোস্কেল অ্যাডিটিভ, বেইসবল ব্যাট, টেনিস র্যাকেট, সাইকেল, মোটরসাইকেল হেলমেট, গাড়ির খুচরো অংশ, লাগেজ,  পাওয়ার টুল হাউজিংয়ে। এর ফলে এসব যানবাহন হয়ে উঠছে আরো হালকা, শক্ত, স্থিতিস্থাপক ও টেকসই। কার্বন ন্যানোটিউব শিট এখন উৎপাদিত হচ্ছে আগামী প্রজন্মের আকাশযান তৈরির জন্য। যেমন : হালকা-পাতলা ও বিদ্যুৎ পরিবাহিতার কারণে এগুলোর প্রয়োগ আদর্শ হয়ে উঠছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক শিল্ডিং ও থার্মাল ম্যানেজমেন্টের জন্য।


কার্বন ন্যানোটিউবের গঠন


এনজাইমের ন্যানো-বায়ো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের লক্ষ্য হচ্ছে কাঠের টুকরা, খড়, সারবিহীন বারোমাসি ঘাস ইত্যাদি থেকে সেলুলোস পরিবর্তন করে জ্বালানির জন্য ইথানল তৈরি করা। সেলুলোসিক ন্যানোম্যাটেরিয়াল শিল্পখাতে ব্যবহারের সমূহ সম্ভাবনা সুপ্রমাণিত। এসব ক্ষেত্রের মধ্যে আছে ইলেকট্রনিকস, নির্মাণ, প্যাকেজিং, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, অটোমোটিভ ও প্রতিরক্ষা খাত। সেলুলোসিক ন্যানোবস্তু অনেক ন্যানোবস্তুর চেয়ে সস্তা। এটি হালকার তুলনায় বেশি শক্ত। ন্যানোইঞ্জিয়ার্ড বস্তু দিয়ে তৈরি অটোমোবাইল পণ্যের মধ্যে আছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রিচার্জযোগ্য ব্যাটারি সিস্টেম, তাপ নিয়ন্ত্রক থার্মোইলেকট্রিক ম্যাটেরিয়াল, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কম খরচের সেন্সর ও ইলেকট্রনিকস, কম রোলিং রেজিস্ট্যান্সের টায়ার এবং হালকা ফিল্মের স্মার্ট সোলার প্যানেল। ক্রমবর্ধমান হারে ন্যানোপার্টিকল ব্যবহার হচ্ছে ক্যাটেলাইসিস হিসেবে; রাসায়নিক বিক্রিয়া বাড়ানোর জন্য। প্রত্যাশিত ফল পেতে এক্ষেত্রে কম পরিমাণে ক্যাটেলাইটিক ম্যাটেরিয়ালের প্রয়োজন হয়। এর ফলে টাকা বাঁচে ও দূষণ কমে। পেট্রোলিয়াম পরিশোধন ও অটোমোটিভ ক্যাটেলাইটিক কনভার্টার হিসেবেও তা ব্যবহার হয়।


ইলেকট্রনিকস ও আইটি ক্ষেত্রে 


ন্যানোটেকনোলজি বড় ধরনের অবদান রাখছে কমপিউটিং ইলেকট্রনিকসের উন্নয়নে। এর মাধ্যমে আমরা পাচ্ছি অধিকতর দ্রæতগতির, ক্ষুদ্রতর ও বহনযোগ্য ব্যবস্থা। আর এগুলো মজুদ করতে পারছে আরো বেশি থেকে বেশি পরিমাণ ইনফরমেশন। আধুনিক কমপিউটিংয়ের বেসিক সুইচ হচ্ছে ট্র্যানজিস্টর। ন্যানোপ্রযুক্তির মাধ্যমে এই ট্র্যানজিস্টর ছোট থেকে আরো ছোট করে আনা হচ্ছে। চলতি শতাব্দীর শুরুতে একটি ট্র্যানজিস্টরের আকার ছিল ১৩০ থেকে ২৫০ ন্যানোমিটার। ২০১৪ সালে ইন্টেল বানায় একটি ১৪ ন্যানোমিটার ট্র্যানজিস্টর। ২০১৫ সালে আইবিএম বানায় প্রথম ৭ ন্যানোমিটার ট্র্র্যানজিস্টর। ২০১৬ সালে লরেন্স বার্কেলি ন্যাশনাল ল্যাব প্রদর্শন করে ১ ন্যানোমিটার আকারের ট্র্যানজিস্টর। এভাবে আরো ক্ষুদ্র ট্র্যানজিস্টরের অর্থ হচ্ছে আরো ছোট, আরো গতিশীল ও আরো ভালো মানের ট্র্যানজিস্টর। খুব শিগগির একটি ছোট্ট চিপে জমা রাখা যাবে একটি কমপিউটারের পুরো মেমরি। ম্যাগনেটিক র্যানডম অ্যাক্সেস মেমরি (এমআরএএম) ব্যবহার করে কমপিউটার প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে বুট করতে পারবে। এমআরএএম-কে সক্ষম করে তোলা হয় ন্যানোমিটার-স্কেল ম্যাগনেটিক টানেল জাঙ্কশন দিয়ে। এই মেমরি দ্রæত ও কার্যকরভাবে ডাটা সেভ করতে পারে সিস্টেম শাটডাউনের সময় কিংবা প্লে-ফিচার চালু থাকার সময়। 


এখন যেসব আল্ট্রা-হাই ডেফিনিশন ডিসপ্লে ও টেলিভিশনগুলো বিক্রি হচ্ছে, এগুলো আরো ভালো ছবির জন্য ব্যবহার করে কোয়ান্টাম ডট। সেই সাথে এগুলো আরো কম জ্বালানি ব্যবহার করে। এখন নমনীয়, বাঁকানো, মোড়ানো ও সম্প্রসারণযোগ্য ইলেকট্রনিক পণ্য এখন তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। পরিধানযোগ্য, চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগী ও ইন্টারনেট অব থিংসে এখন ব্যবহার হচ্ছে ন্যানোস্কেলের সেন্সর। স্মার্টফোন ও ই-রিডার ডিসপ্লেতেও ব্যবহার হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর ন্যানোমেমব্রেন। গ্রাফিন ও সেলুলোসের মতো অন্যান্য ন্যানোবস্তু ব্যবহার হচ্ছে পরিধানযোগ্য ইলেকট্রনিকসে। স্মার্টফোনের জন্য ফ্ল্যাশ মেমরি চিপ ও থাম্ব ড্রাইভের মতো অন্যান্য কমপিউটিং ও ইলেকট্রনিক পণ্যে ব্যবহার হচ্ছে ন্যানোপ্রযুক্তি। আল্ট্রারেসপন্সিভ হেয়ারিং এইড, কিবোর্ড ও স্মার্টফোনের আবরণে ব্যবহার হচ্ছে ব্যাকটেরিয়ারোধী ন্যানোবস্তু।


চিকিৎসায় ন্যানোপ্রযুক্তি


চিকিৎসার ক্ষেত্রে ন্যানোপ্রযুক্তির প্রয়োগ সম্প্রসারিত হচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ, রোগ চিহ্নিত করা, চিকিৎসার আরো নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে ন্যানোপ্রযুক্তি। ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে গোল্ড ন্যানোপ্লাস্টিক। উন্নততর ইমেজিং ও ডায়াগনস্টিক যন্ত্রগুলো আরো সমৃদ্ধ হচ্ছে ন্যানোপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে। ডায়াগনসিস ও থেরাপিউটিকের ক্ষেত্রে সাফল্যসীমা বাড়ছে এই প্রযুক্তিসূত্রেই। ন্যানোপ্রযুক্তি গবেষকেরা কাজ করছেন বেশ কিছুসংখ্যক থেরাপিউটিকের ওপর। এর ফলে ন্যানোপার্টিকল এনক্যাপসুলেট করা কিংবা ক্যান্সার কোষের যথাস্থানে ওষুধ প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে। এতে কোষগুলো ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা কমে এসেছে। এর ফলে আরো উন্নততর ক্যান্সার চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে কেমোথেরাপির বিষাক্ত প্রভাব। 


জৈব-প্রকৌশল ও ন্যানোপ্রযুক্তি


গবেষকেরা কাজ করছেন রিজেনারেটিভ মেডিসিনের কয়েকটি প্রয়োগক্ষেত্রে; ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে। এর মধ্যে আছে হাড় ও স্নায়ুবিক টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং। যেমন : নোবেল ম্যাটেরিয়ালকে ইঞ্জিনিয়ারিং করা যাবে মানুষের হাড়ের স্বচ্ছ দানাদার (ক্রিস্টাল) মিনারেল স্ট্রাকচারে কৃত্রিমতা আনতে। দাঁতের ক্ষেত্রে তা ব্যবহার হয় রেস্টোরেটিভ রেজিন হিসেবে। গবেষকেরা চেষ্টা করছেন একটি জটিল টিস্যু উৎপাদনের। ভবিষ্যতে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের লক্ষ্য নিয়ে তারা তা করছেন। তা ছাড়া গবেষণা চলছে গ্র্যাফিন ন্যানোরিবন ব্যবহারের উপায় বের করার জন্য, যাতে মেরুদন্ড মেরামতে তা কাজে লাগানো যায়। ভ্যাকসিনের উন্নয়নেও ন্যানোপ্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। তারা চেষ্টা করছেন বার্ষিক ফ্লুর জন্য একটি ইউনিভার্সেল ভ্যাকসিন তৈরির ব্যাপারে।


জ্বালানি খাতে ন্যানোপ্রযুক্তি


প্রচলিত জ্বালানি উৎসের ক্ষেত্রেও ন্যানোপ্রযুক্তির প্রয়োগের উপায় খুঁজে পাওয়া গেছে। ন্যানোপ্রযুক্তির সাহায্যে বিকল্প জ্বালানি উদ্যোগ জোরদার করে তোলা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা পরিষ্কার, কমদামের ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন। ন্যানোপ্রযুক্তির সাহায্যে জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। 


ন্যানোপ্রযুক্তিতে উন্নততর ক্যাটালাইসিসের মাধ্যমে অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম থেকে জ্বালানি উৎপাদনের দক্ষতা বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। এতে পরিবেশের দূষণ কমবে; বিদ্যুৎকেন্দ্র ও যানবাহনেও জ্বালানি ব্যবহার কমবে। গ্যাস ও তেল উত্তোলনেও ব্যবহার হচ্ছে এই প্রযুক্তি। ন্যানোপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ গ্যাস লিফট ভাল্ব খুঁজে বের করছে তেলের পাইপের অতিক্ষুদ্র ছিদ্র বা ফাটল। অনেক নতুন ধরনের ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে ন্যানোপ্রযুক্তি। কার্বন ন্যানোটিউব ব্যবহার হচ্ছে উইন্ডমিলের ব্লেড তৈরিতে। জ্বালানি খাতে রয়েছে ন্যানোপ্রযুক্তির এমনি আরো ব্যবহার। পরিবেশের উন্নয়নে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপকভাবে। 


ভবিষ্যৎ যানবাহন ও ন্যানোপ্রযুক্তি


ন্যানোপ্রযুক্তি মাল্টিফাঙ্কশনাল ম্যাটেরিয়াল তৈরির যে দুয়ার খুলে দিয়েছে, তা অমিত সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে হালকা-পাতলা ও অধিকতর কার্যকর স্মার্ট যানবাহন, উড়োজাহাজ, জাহাজ, মহাকাশযান তৈরির। এ ছাড়া ন্যানোপ্রযুক্তি সুযোগ করে দিয়েছে পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়নের। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রিচার্জযোগ্য ব্যাটারি সিস্টেম, তাপ নিয়ন্ত্রণের থার্মোইলেকট্রিক্যাল ম্যাটেরিয়াল, কম রুলিং রেজিস্ট্যান্স টায়ার, উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কম খরচের সেন্সর ও ইলেকট্রনিকস, পাতলা ফিল্মের স্মার্ট সোলার প্যানেল, ফুয়েল অ্যাডিটিভ, উন্নত ক্যাটেলাইটিক কনভার্টার ইত্যাদি এখন ব্যবহার হচ্ছে যানবাহনে। অ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাত, অ্যাসপল্ট, কংক্রিট ও অন্যান্য সিমেন্টিয়াস  ম্যাটেরিয়াল ও এগুলোর রিসাইকল আকার ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে মহাসড়কের যানবাহনের কার্যক্ষমতা ও দীর্ঘস্থায়িত্বে। এসব ম্যাটেরিয়াল রিসাইকল খরচও অনেকটা কমে এসেছে। ন্যানোসেন্সর ও ডিভাইস সেতু, টানেল, রেললাইন, পার্কিং কাঠামো ও বাঁধের সাশ্রয়ী খরচে অব্যাহত মনিটরিংয়ের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। ন্যানোস্কেল সেন্সর, কমিউনিকেশন ডিভাইস  ও অন্যান্য উদ্ভাবনা যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন জোরদার করে তুলতে পারে। এখন ন্যানোপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ হালকা ওজনের অতি শক্ত বস্তু ব্যবহার হচ্ছে প্রায় সব ধরনের যানবাহনে। হিসাব করে দেখা গেছে, বাণিজ্যিক জেট বিমানের ওজন ২০ শতাংশ কমে যাওয়ায় জ্বালানি খরচ কমবে ১৫ শতাংশ। নাসার প্রাথমিক এক বিশ্লেষণ মতে, অগ্রসর মানের ন্যানোম্যাটেরিয়াল তৈরি ও ব্যবহার যানবাহনের ওজন ৬৩ শতাংশ কমে যেতে পারে। এর ফলে শুধু জ্বালানি খরচই কমবে না, সেই সাথে কমবে এগুলো তৈরির খরচও। 


শুরুর কথা


প্রশ্ন হচ্ছে, যুগান্তকারী এই ন্যানোম্যাটেরিয়াল বা ন্যানোপ্রযুক্তির ভাবনাটা সর্বপ্রথম কার মাথা থেকে এলো? জানা যায়, ন্যানোর এই ধারণাটা প্রথম দিয়েছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান। ১৯৫৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির এক সভায় তিনি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার বক্তৃতার শিরোনাম ছিল : ‘দেয়ার ইজ প্লেন্টি অব রুম অ্যাট দ্য বটম’। 


সবাইকে অবাক করে এই বক্তৃতায় তিনি জানিয়েছিলেন এক নয়া বস্তুজগতের কথা, যা আমাদের মধ্যে থেকেও আসলে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই বস্তুজগত কোয়ান্টাম সূত্র মেনে চলে। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন কমপিউটার ছিল একটি অতিকায় যন্ত্র। রীতিমতো একটি ঘরের আকারের। সেই সময়ে ফাইনম্যান তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, অণু-পরমাণু সুবিধামতো সাজিয়ে সঠিক মাপমতো কিছু তৈরির কথা। বলেছিলেন এক বালিকণার মাপের বস্তুর তথ্যভান্ডারের কথা। জীবকোষকে মডেল হিসেবে ধরে এত ছোট অথচ বিচিত্র কার্যকারিতার মেশিন তৈরির কথা। তখনকার দিকে এই ধারণা অনেকের কাছে খুবই অবাক করা ব্যাপার ছিল। অনেক বিজ্ঞানী এই ধারণাকে ফাইনম্যানের স্বভাবসিদ্ধ ‘প্র্যাকটিক্যাল জোক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে সত্য কথা বলতে কী, ওই ‘প্লেন্টি অব রুম’ যে ঠিক কতখানি নিচে কিংবা  মিনিয়েচারাইজেশন বা ক্ষুদ্রায়নই কোন পর্যায়ের, সে ধারণাটা তখন ফাইনম্যানেরও ছিল না। 


ফাইনম্যান তার বক্তৃতার সময় দুটি চ্যালেঞ্জের কথা বলে ১ হাজার ডলার করে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তা একটি চ্যালেঞ্জ মাত্র এক বছরের মধ্যেই ১৯৬০ সালে সম্ভব হয়ে উঠেছিল। সেটা ছিল মাত্র ০.৪ মিলিমিটার ঘনকের আকারের বিদ্যুৎচালিত মোটর তৈরি করা। অপরটি ছিল বইয়ের পাতার আয়তন ২৫ হাজার ভাগ কমানো। সেটি করা অবশ্য সম্ভব হয় ১৯৮৫ সালে, ২৬ বছর পরে।  


সে যা-ই হোক, ফাইনম্যান কিন্তু ‘ন্যানো’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। টোকিও সায়েন্স ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী নোরিও আনিগুচি ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম ‘ন্যানোটেকনোলজি’ শব্দটি উচ্চারণ করেন এবং এর একটি সুস্পষ্ট সংজ্ঞাও দেন। তবে এই ন্যানোকে লালন-পালন করে একটি বিশ্বাসিযোগ্য জায়গায় এনে পৌঁছানোর কৃতিত্ব কিন্তু বিজ্ঞানী এরিক ডেক্সলারের।  ন্যানোবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রকৃত রূপটা তুলে ধরা ও এর উপকারিতার দিকটি স্পষ্ট করাই ছিল ডেক্সলারের স্বপ্ন। তিনি বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘ফোরসাইট ইনস্টিটিউট’। এ ইনস্টিটিউটের কাজ ছিল ন্যানোপ্রযুক্তির নানা ধারণা চর্চা করা। ফাইনম্যানের চ্যালেঞ্জ শেষ হওয়ার পর ফোরসাইট ইনস্টিটিউট এই বার্ষিক পুরস্কারটি আবার চালু করেছিল। ডেক্সলারের ১৯৮৬ সালে লেখা ‘ইঞ্জিনস অব ক্রিয়েশন : দ্য কামিং এরা অব ন্যানোটেকনোলজি’ বইটি হচ্ছে এ বিষয়ের প্রথম বই। এ ছাড়া ডেক্সলার ১৯৯২ সালে ‘ন্যানোসিস্টেমস : মলিকুলার মেশিনারি, ম্যানুফেকচারিং অ্যান্ড কমপিউটেশন’ নামে আরো একটি বই লিখেছিলেন। এরপর থেকেই ন্যানোটেকনোলজি এক প্রতিষ্ঠিত রূপ লাভ করে।








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।